ঢাকা ০৬:২৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক পেলেন মালাপাড়া’র কৃতিসন্তান শহীদ খাজা নিজামুদ্দিন 

বাংলাদেশের বার্তা
  • আপডেট সময় : ০২:১১:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩
  • / ৯৬২৩ বার পড়া হয়েছে
বাংলাদেশের বার্তা অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

শাহ্জালাল আল-নাগর।

পুলিশ লাইন – কান্দিরপাড় রোড যার নামে নামকরণ করা হয়েছে তিনি হলেন শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন (বীর_উত্তম.,)

এবার জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম) কে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় এই বেসামরিক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। গত ৯ মার্চ (বৃহস্পতিবার) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৩ এর জন্য মনোনীতদের তালিকায় ব্রাহ্মণপাড়ার এই কৃতি সন্তানের নাম প্রকাশ হয়।

কুমিল্লার গর্বিত সন্তান বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর-উত্তম খেতাব প্রদান করে।

কানাইঘাট লক্ষ্ণীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির বড়খেয়ড় গ্রামে শায়িত আছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। সাবেক সেনা ও ইপিআরের মধ্যে একমাত্র বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য।

তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া গ্রামে। পিতার নাম আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া ও মাতার নাম তাবেন্দা আখতার চৌধুরানী। বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সড়কের বাজারসংলগ্ন কটালপুর ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়ে শহীদ হন। বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষনপাড়া উপজেলার মালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে মাকে না বলে দেশ স্বাধীন করতে ছুটে গিয়েছিলেন যে তরুণ, তিনিই পরে নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়েছেন ৮০০ সহযোদ্ধার প্রাণ। কোনো দিন মহসীন হল, কোনো দিন খালার বাসা এভাবেই থাকতেন খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন এমবিএ ৩য় ব্যাচে পড়তেন নিজাম। দিনে চাকরি করেন ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে, রাতে ক্লাস করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হোটেলের বিদেশি সাংবাদিকের মুখেই শুনেছিলেন, রাতে ঢাকা আক্রমণ করবে পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে সেদিন হলে না ফিরে চলে গেলেন পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনের খালার বাড়িতে। রাতভর হলের বন্ধুদের চিন্তায় ঘুম এলো না।

সকালে ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য কারফিউ উঠলে, হলে ছুটে গেলেন। গিয়ে দেখলেন নিথর পড়ে আছে প্রিয় বন্ধুদের মুখগুলো, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। এ দৃশ্যই পুরোপুরি বদলে দিল তাকে। সেদিনই খালার পরিবারকে কুমিলস্না শহরের করবী বাগিচাগাঁওয়ে মা-বাবার কাছে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

কুমিল্লা শহরের তরুণদের ডেকে ঢাকার ঘটনা বললেন, বারবার অনুরোধ করলেন আপনারা কিছু করুন। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা বেরিয়ে পড়তে পারে ভেবে দুই পরিবারকে বুড়িচংয়ে গ্রামের বাড়িতে রেখে মাকে বললেন, ‘খালার বাড়িতে গিয়ে কয়েক দিন থাকি?’ সেখানেই তো ছেলে ছিল, নিশ্চয়ই তাদের জন্য মন পুড়ছে; তাই মা আপত্তি করলেন না। খালাতো ভাই গিয়াসকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নিজাম। আশরাফ নামের আরেক পরিচিতকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরা চলে গেলেন।

এপ্রিলের শুরুতে আগরতলা গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ হলো। প্রবাসী সরকারের নানা কাজেও স্বেচ্ছাসেবা দিলেন। এরপর অস্ত্র হাতে লড়তে গেলেন তিনি। আগরতলার কাছে ইন্দ্রনগরের ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে মে মাসের শুরুতে মুক্তিফৌজের একজন হিসেবে চলে এলেন সিলেটের কানাইঘাটে। তখনো সেক্টরগুলো তৈরি হয়নি। ছোট ছোট দলে অপারেশন করে সিলেট মুক্ত রাখছিলেন নিজামের মতো মুক্তিসেনারা। ৪ নম্বর সেক্টর গঠিত হলে সেক্টর কমান্ডার মেজর সি আর দত্তের অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হলেন খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। তিনিই সাবেক সেনা ও ইপিআরের মধ্যে একমাত্র বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা।

ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়ল তার কাঁধে। মেধাবী ও পরিশ্রমী মুক্তিযোদ্ধাটির সহকর্মীদের প্রতি মমতা দেখে সবাই খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে ভালোবেসে ফেললেন। তখনো বাড়িতে কেউ জানে না, দেশ মুক্ত করতে গিয়েছেন তিনি। তার পরিবারের অবস্থা তখন বেশ করুণ। সরকারের রাজস্ব বিভাগের সাবডিভিশনাল ম্যানেজার বাবা আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন। বড় ভাই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মোস্তফা কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া পাকিস্তানে কর্মরত আরো অনেক বাঙালি অফিসারের মতো বন্দি।

সেজো ভাই শাহজালাল উদ্দিন ভূঁইয়া কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর দশম শ্রেণির ছাত্র আলস্নামা ইকবাল উদ্দিন ভূঁইয়াও মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। সবই জেনেছেন পিতা। এতদিনে নিজামের হদিস না পেয়ে মা তাবেন্দা আখতার চৌধুরানী বাবা আব্দুল লতিফ ভূঁঁইয়া দুশ্চিন্তায় অস্থির।

অনেক দিন পর খালাতো বোনের স্বামী বাড়ি এসে জানালেন, বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। তত দিনে অভাব তাদের পেয়ে বসেছে। নিজের সামান্য মাসোহারার টাকা মানি অর্ডার করে বাড়িতে পাঠাতে লাগলেন নিজাম। তবে দুই-তিন মাস পাঠানোর সৌভাগ্য হয়েছে তার। যুদ্ধের অবসরে মায়ের জন্য মন পোড়ে। একদিন সেক্টর কমান্ডারকে বলেই ফেললেন ‘স্যার, আমাকে কুমিল্লায় পাঠান। যুদ্ধ করার ফাঁকে মা-বাবাকে একবার দেখব। ঠিক আছে, যুদ্ধ শেষে যেয়ো- বললেন সি আর দত্ত।

৩ সেপ্টেম্বর রাতে ৮০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সাব-সেক্টর কমান্ডার খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। সিলেটের কানাইঘাটের কাঠালপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেবেন। পাকিস্তানি বাহিনী আর এগোতে পারবে না। রাতভর যুদ্ধ করে অসম সাহসী বাঙালি তরুণ দল ব্রিজ উড়িয়ে দিল। তবে যুদ্ধ থামল না। থেমে থেমে গোলাগুলি হচ্ছে। হঠাৎ তারা টের পেলেন গুলি ফুরিয়ে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীও পরিস্থিতি টের পেয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ধরার ছক কষছে। তখনই তাদের নেতা এগিয়ে এলেন। হাতে সাব-মেশিনগান। সহযোদ্ধাদের বললেন, ‘তোমরা পিছে চলে যাও, আমি ওদের দেখছি।’ নিরাপদে সরে যেতে লাগলেন সবাই। নিজাম অনবরত গুলি ছুড়ছেন। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার হাতে লাগল। তবুও অস্ত্র ফেলে দেননি। রক্ত ঝরা হাত নিয়েই দম আটকে গুলি করছেন। মুক্তিসেনারাও নিরাপদে চলে যাচ্ছেন। একটি গুলি আহত মুক্তিযোদ্ধার বুকে লাগল। তবুও দাঁড়িয়ে আছেন, গুলি করছেন। আরেকটি গুলি মাথায় বিদ্ধ হওয়ার পর আর পারলেন না। একপাশে ঢলে পড়লেন। ‘লা ইলাহা ইল্লালাহো মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পড়ার শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালেন সহযোদ্ধারা। মৃতু্যর ঝুঁকি উপেক্ষা করে এই বীরের লাশ নিয়ে তবেই তারা ফিরেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী চেয়েছিল, এই অকৃত্রিম বন্ধুর কবর ভারতেই দেওয়া হোক। তবে মুক্তিযোদ্ধারা আপন দেশের মাটিতেই চিরদিনের জন্য রেখে দেবেন তাকে। কোনোভাবেই দুই পক্ষের সমঝোতা হলো না।

অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি সিলেটের কৃতী সন্তান এম এ জি ওসমানী বললেন, নিজাম বাংলাদেশে থাকবে। সিলেটের কানাইঘাটের মন্তাজগঞ্জ বাজারের পাশে বড়খেয়ড় গ্রামে পাতা শাহ মোকাম টিলার চূড়ায় তিন পীর হজরত লালশাহ, হজরত পাতাশাহ, হজরত গোলাপ শাহ (রহ.)-এর কবর। সেখানেই টিলার পার্শ্বে দাফন করা হলো খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে। অন্যদের বিশ্বাস হবে না বলে স্মৃতি হিসেবে তার গায়ের শার্টটি খুলে নিলেন সহযোদ্ধারা। সেটি পরেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। ৪ সেপ্টেম্বর রাতেই স্বাধীন বাংলা বেতারের ঘোষণায় তার এলাকার মানুষও জানল, তাদের গ্রামের নিজাম সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে আত্মদান করেছেন। তবে তাদেরও বিশ্বাস হলো না, দুদিন আগেও তো তিনি মাকে চিঠি লিখেছেন! বিশ্বাস করতে পারেননি তার মা তাবেন্দা আকতার চৌধুরানী। স্বাধীনতার পর সহযোদ্ধারা নিজামের শার্ট ও ঘড়ি বাড়িতে দিয়ে গেছেন। তার পরও নিজাম ফিরবে এ আশায় প্রতিটি দিন রাস্তার পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতেন মা।

ছেলের শোকে ১৯৭৭ সালেই তিনি ইন্তেকাল করেন। বাবা আবদুল লতিফ ভূঁইয়া আর কোনো দিন চাকরিতে যোগদান করতে পারেননি। তিনি মারা যান ১৯৮০ সালে। শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’র কবরকে কানাইঘাটবাসী ‘ক্যাপ্টেন নিজামের কবর’ নামে চিনেন। কানাইঘাটবাসী সহমুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে এখনো খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া গল্প শোনা যায়। নিজামের সহযোদ্ধারা বলেন, একজন সেনা অফিসার ছাড়া এত বিক্রম সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রদর্শন করা সম্ভব নয়।

জানা যায়, ৬ ভাই ৩ বোনের মধ্যে নিজাম ছিলেন ২য় সন্তান। খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার বড় ভাই ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বর্তমানে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আলস্নামা ইকবাল উদ্দিন ভূঁইয়া (কানাডা প্রবাসী), আরেক ভাই হাসান মহিউদ্দিন ভূঁইয়া (ব্যাংকার)। নিজাম উদ্দিনের আরেক ছোট ভাই হাসান মহিউদ্দিন ভূঁইয়া জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধির জন্য প্রস্তাব করা হলেও আলোচনার ভিত্তিতে ‘বীর-উত্তম’ খেতাব দেওয়া হয়।

তিনিই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ একমাত্র বেসামরিক বীর-উত্তম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট তাদের এই ছাত্র নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার স্মৃতি অম্স্নান রাখতে আইবিএর প্রবেশপথে তার মু্যরাল তৈরি করছে। মাস্টার্সের সেরা ছাত্র হিসেবে এবার তার নামে স্বর্ণপদক দেওয়া হবে।’ জানালেন পরিচালক ড. এ কে এম সাইফুল মজিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিজনেস ফ্যাকাল্টির বিশতলা ভবনটি শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’-এর নামে নির্মাণ করা হবে।

খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার বড় ভাই ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামালউদ্দিন ভূঁইয়া জানান, ঢাকার মালিবাগ রেলগেট থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের বিশ্ব রোডটি ‘খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া নামে নামকরণ করা হয়েছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শহীদ মিনারটিও ‘খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া বীর-উত্তম শহীদ মিনার’ নামকরণ হয়েছে।

কথা হয় শহীদ বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার কানাডা প্রবাসী ভাতিজা এহতেশাম ইকবাল ভূঁইয়া জানান, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া গ্রামে ‘খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া বীর-উত্তম নামে কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে গ্রামের বাড়িতে। কবরী-বাগিচাগাঁও এবং মূল কান্দিরপাড় থেকে পুলিশলাইন সড়কের নামও ‘বীর উত্তম খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া সড়ক’ রাখা হয়েছে।

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্ণীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির মন্তাজগঞ্জ বাজার সংলগ্ন বড়খেয়ড় এলাকায় শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’র কবর কমপ্লেক্স ও স্মৃতিস্তম্বের পার্শ্বে তার নামে একটি মসজিদ ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া বড়খেয়ড় এলাকায় তার নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রস্তাব প্রক্রিয়াদিন রয়েছে।

শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’র নামে কানাইঘাটের মন্তাজগঞ্জ-বড়খেয়ড় রাস্তা এবং প্রস্তাবিত (মন্তাজগঞ্জ-দর্পনগর) সুরমা ব্রিজটি তার নামে নামকরণের জোরালো দাবি করছেন এলাকাবাসী। এদিকে শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া বীর-উত্তম’র স্মৃতি রক্ষায় প্রতি বছর ৪ সেপ্টেম্বর তার স্মরণে স্মৃতি কমপ্লেক্স মাঠে শাহাদাৎবার্ষিকী এবং ১৯ ফেব্রম্নয়ারি জন্মদিন পালন করে শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’ স্মৃতি পরিষদ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর দ্বিতীয়। আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক (মরণোত্তর) পুরষ্কারে ভূষিত হওয়ায় আমাদের পরিবার, গ্রাম, উপজেলা ও সমগ্র কুমিল্লা জেলার জন্য এক বিরাট সম্মান ও গর্বের অর্জন।গত ২৩ মার্চ সকালে ঢাকা ওসমানী মিলনায়তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আমার ভাইয়ের এই সম্মাননা পদক আমাদের পরিবার গ্রহন করেন।

“স্বাধীনতা পুরস্কার” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ব্রাহ্মণপাড়ার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত হওয়া ব্রাহ্মণপাড়া তথা সমগ্র কুমিল্লা জেলার জন্য এক বিরাট সম্মান ও গৌরব অর্জন। এই বিশাল প্রাপ্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ও তার পরিবারের সকলকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন (বীরউত্তম) এর সহোদর জনাব হাজান মহিউদ্দিন ভূইয়া মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে স্বাধীনতা পুরুস্কার ২০২৩ গ্রহন করেছেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

ট্যাগস :

মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক পেলেন মালাপাড়া’র কৃতিসন্তান শহীদ খাজা নিজামুদ্দিন 

আপডেট সময় : ০২:১১:১১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৭ মার্চ ২০২৩

শাহ্জালাল আল-নাগর।

পুলিশ লাইন – কান্দিরপাড় রোড যার নামে নামকরণ করা হয়েছে তিনি হলেন শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন (বীর_উত্তম.,)

এবার জাতীয় পর্যায়ে গৌরবোজ্জ্বল কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম) কে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় এই বেসামরিক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। গত ৯ মার্চ (বৃহস্পতিবার) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক বিজ্ঞপ্তিতে (মরণোত্তর) স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৩ এর জন্য মনোনীতদের তালিকায় ব্রাহ্মণপাড়ার এই কৃতি সন্তানের নাম প্রকাশ হয়।

কুমিল্লার গর্বিত সন্তান বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর-উত্তম খেতাব প্রদান করে।

কানাইঘাট লক্ষ্ণীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির বড়খেয়ড় গ্রামে শায়িত আছেন জাতির এই শ্রেষ্ঠ সন্তান। সাবেক সেনা ও ইপিআরের মধ্যে একমাত্র বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা। বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন দেশের জন্য।

তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া গ্রামে। পিতার নাম আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া ও মাতার নাম তাবেন্দা আখতার চৌধুরানী। বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ১৯৭১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের কানাইঘাট সড়কের বাজারসংলগ্ন কটালপুর ব্রিজ ধ্বংস করতে গিয়ে শহীদ হন। বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ১৯৪৯ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লা জেলার ব্রাক্ষনপাড়া উপজেলার মালপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে মাকে না বলে দেশ স্বাধীন করতে ছুটে গিয়েছিলেন যে তরুণ, তিনিই পরে নিজের জীবন দিয়ে বাঁচিয়েছেন ৮০০ সহযোদ্ধার প্রাণ। কোনো দিন মহসীন হল, কোনো দিন খালার বাসা এভাবেই থাকতেন খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্যকালীন এমবিএ ৩য় ব্যাচে পড়তেন নিজাম। দিনে চাকরি করেন ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে, রাতে ক্লাস করেন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হোটেলের বিদেশি সাংবাদিকের মুখেই শুনেছিলেন, রাতে ঢাকা আক্রমণ করবে পাকিস্তানি বাহিনী। ফলে সেদিন হলে না ফিরে চলে গেলেন পুরান ঢাকার অভয় দাস লেনের খালার বাড়িতে। রাতভর হলের বন্ধুদের চিন্তায় ঘুম এলো না।

সকালে ঘণ্টা দু’য়েকের জন্য কারফিউ উঠলে, হলে ছুটে গেলেন। গিয়ে দেখলেন নিথর পড়ে আছে প্রিয় বন্ধুদের মুখগুলো, রক্তে ভেসে যাচ্ছে শরীর। এ দৃশ্যই পুরোপুরি বদলে দিল তাকে। সেদিনই খালার পরিবারকে কুমিলস্না শহরের করবী বাগিচাগাঁওয়ে মা-বাবার কাছে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

কুমিল্লা শহরের তরুণদের ডেকে ঢাকার ঘটনা বললেন, বারবার অনুরোধ করলেন আপনারা কিছু করুন। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি সেনারা বেরিয়ে পড়তে পারে ভেবে দুই পরিবারকে বুড়িচংয়ে গ্রামের বাড়িতে রেখে মাকে বললেন, ‘খালার বাড়িতে গিয়ে কয়েক দিন থাকি?’ সেখানেই তো ছেলে ছিল, নিশ্চয়ই তাদের জন্য মন পুড়ছে; তাই মা আপত্তি করলেন না। খালাতো ভাই গিয়াসকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন নিজাম। আশরাফ নামের আরেক পরিচিতকে নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে ত্রিপুরা চলে গেলেন।

এপ্রিলের শুরুতে আগরতলা গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন, ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গেও যোগাযোগ হলো। প্রবাসী সরকারের নানা কাজেও স্বেচ্ছাসেবা দিলেন। এরপর অস্ত্র হাতে লড়তে গেলেন তিনি। আগরতলার কাছে ইন্দ্রনগরের ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ শেষে মে মাসের শুরুতে মুক্তিফৌজের একজন হিসেবে চলে এলেন সিলেটের কানাইঘাটে। তখনো সেক্টরগুলো তৈরি হয়নি। ছোট ছোট দলে অপারেশন করে সিলেট মুক্ত রাখছিলেন নিজামের মতো মুক্তিসেনারা। ৪ নম্বর সেক্টর গঠিত হলে সেক্টর কমান্ডার মেজর সি আর দত্তের অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত হলেন খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। তিনিই সাবেক সেনা ও ইপিআরের মধ্যে একমাত্র বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধা।

ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পড়ল তার কাঁধে। মেধাবী ও পরিশ্রমী মুক্তিযোদ্ধাটির সহকর্মীদের প্রতি মমতা দেখে সবাই খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে ভালোবেসে ফেললেন। তখনো বাড়িতে কেউ জানে না, দেশ মুক্ত করতে গিয়েছেন তিনি। তার পরিবারের অবস্থা তখন বেশ করুণ। সরকারের রাজস্ব বিভাগের সাবডিভিশনাল ম্যানেজার বাবা আব্দুল লতিফ ভূঁইয়া ছুটি নিয়ে বাড়ি এসেছেন। বড় ভাই সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মোস্তফা কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া পাকিস্তানে কর্মরত আরো অনেক বাঙালি অফিসারের মতো বন্দি।

সেজো ভাই শাহজালাল উদ্দিন ভূঁইয়া কুমিলস্না ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। আর দশম শ্রেণির ছাত্র আলস্নামা ইকবাল উদ্দিন ভূঁইয়াও মুক্তিযুদ্ধে চলে গেছেন। সবই জেনেছেন পিতা। এতদিনে নিজামের হদিস না পেয়ে মা তাবেন্দা আখতার চৌধুরানী বাবা আব্দুল লতিফ ভূঁঁইয়া দুশ্চিন্তায় অস্থির।

অনেক দিন পর খালাতো বোনের স্বামী বাড়ি এসে জানালেন, বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। তত দিনে অভাব তাদের পেয়ে বসেছে। নিজের সামান্য মাসোহারার টাকা মানি অর্ডার করে বাড়িতে পাঠাতে লাগলেন নিজাম। তবে দুই-তিন মাস পাঠানোর সৌভাগ্য হয়েছে তার। যুদ্ধের অবসরে মায়ের জন্য মন পোড়ে। একদিন সেক্টর কমান্ডারকে বলেই ফেললেন ‘স্যার, আমাকে কুমিল্লায় পাঠান। যুদ্ধ করার ফাঁকে মা-বাবাকে একবার দেখব। ঠিক আছে, যুদ্ধ শেষে যেয়ো- বললেন সি আর দত্ত।

৩ সেপ্টেম্বর রাতে ৮০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে এগিয়ে চলেছেন সাব-সেক্টর কমান্ডার খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া। সিলেটের কানাইঘাটের কাঠালপুর ব্রিজ উড়িয়ে দেবেন। পাকিস্তানি বাহিনী আর এগোতে পারবে না। রাতভর যুদ্ধ করে অসম সাহসী বাঙালি তরুণ দল ব্রিজ উড়িয়ে দিল। তবে যুদ্ধ থামল না। থেমে থেমে গোলাগুলি হচ্ছে। হঠাৎ তারা টের পেলেন গুলি ফুরিয়ে আসছে। পাকিস্তানি বাহিনীও পরিস্থিতি টের পেয়ে চারদিক থেকে ঘিরে ধরার ছক কষছে। তখনই তাদের নেতা এগিয়ে এলেন। হাতে সাব-মেশিনগান। সহযোদ্ধাদের বললেন, ‘তোমরা পিছে চলে যাও, আমি ওদের দেখছি।’ নিরাপদে সরে যেতে লাগলেন সবাই। নিজাম অনবরত গুলি ছুড়ছেন। হঠাৎ একটি গুলি এসে তার হাতে লাগল। তবুও অস্ত্র ফেলে দেননি। রক্ত ঝরা হাত নিয়েই দম আটকে গুলি করছেন। মুক্তিসেনারাও নিরাপদে চলে যাচ্ছেন। একটি গুলি আহত মুক্তিযোদ্ধার বুকে লাগল। তবুও দাঁড়িয়ে আছেন, গুলি করছেন। আরেকটি গুলি মাথায় বিদ্ধ হওয়ার পর আর পারলেন না। একপাশে ঢলে পড়লেন। ‘লা ইলাহা ইল্লালাহো মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ পড়ার শব্দ শুনে পেছন ফিরে তাকালেন সহযোদ্ধারা। মৃতু্যর ঝুঁকি উপেক্ষা করে এই বীরের লাশ নিয়ে তবেই তারা ফিরেছেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী চেয়েছিল, এই অকৃত্রিম বন্ধুর কবর ভারতেই দেওয়া হোক। তবে মুক্তিযোদ্ধারা আপন দেশের মাটিতেই চিরদিনের জন্য রেখে দেবেন তাকে। কোনোভাবেই দুই পক্ষের সমঝোতা হলো না।

অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি সিলেটের কৃতী সন্তান এম এ জি ওসমানী বললেন, নিজাম বাংলাদেশে থাকবে। সিলেটের কানাইঘাটের মন্তাজগঞ্জ বাজারের পাশে বড়খেয়ড় গ্রামে পাতা শাহ মোকাম টিলার চূড়ায় তিন পীর হজরত লালশাহ, হজরত পাতাশাহ, হজরত গোলাপ শাহ (রহ.)-এর কবর। সেখানেই টিলার পার্শ্বে দাফন করা হলো খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে। অন্যদের বিশ্বাস হবে না বলে স্মৃতি হিসেবে তার গায়ের শার্টটি খুলে নিলেন সহযোদ্ধারা। সেটি পরেই মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিলেন তিনি। ৪ সেপ্টেম্বর রাতেই স্বাধীন বাংলা বেতারের ঘোষণায় তার এলাকার মানুষও জানল, তাদের গ্রামের নিজাম সহযোদ্ধাদের বাঁচাতে আত্মদান করেছেন। তবে তাদেরও বিশ্বাস হলো না, দুদিন আগেও তো তিনি মাকে চিঠি লিখেছেন! বিশ্বাস করতে পারেননি তার মা তাবেন্দা আকতার চৌধুরানী। স্বাধীনতার পর সহযোদ্ধারা নিজামের শার্ট ও ঘড়ি বাড়িতে দিয়ে গেছেন। তার পরও নিজাম ফিরবে এ আশায় প্রতিটি দিন রাস্তার পাশের জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতেন মা।

ছেলের শোকে ১৯৭৭ সালেই তিনি ইন্তেকাল করেন। বাবা আবদুল লতিফ ভূঁইয়া আর কোনো দিন চাকরিতে যোগদান করতে পারেননি। তিনি মারা যান ১৯৮০ সালে। শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’র কবরকে কানাইঘাটবাসী ‘ক্যাপ্টেন নিজামের কবর’ নামে চিনেন। কানাইঘাটবাসী সহমুক্তিযোদ্ধাদের মুখে মুখে এখনো খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া গল্প শোনা যায়। নিজামের সহযোদ্ধারা বলেন, একজন সেনা অফিসার ছাড়া এত বিক্রম সাধারণ মানুষের পক্ষে প্রদর্শন করা সম্ভব নয়।

জানা যায়, ৬ ভাই ৩ বোনের মধ্যে নিজাম ছিলেন ২য় সন্তান। খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার বড় ভাই ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামাল উদ্দিন ভূঁইয়া বর্তমানে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ছোট ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা আলস্নামা ইকবাল উদ্দিন ভূঁইয়া (কানাডা প্রবাসী), আরেক ভাই হাসান মহিউদ্দিন ভূঁইয়া (ব্যাংকার)। নিজাম উদ্দিনের আরেক ছোট ভাই হাসান মহিউদ্দিন ভূঁইয়া জানান, ‘মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্য নিজামউদ্দিন ভূঁইয়াকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধির জন্য প্রস্তাব করা হলেও আলোচনার ভিত্তিতে ‘বীর-উত্তম’ খেতাব দেওয়া হয়।

তিনিই মুক্তিযুদ্ধে শহীদ একমাত্র বেসামরিক বীর-উত্তম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট তাদের এই ছাত্র নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার স্মৃতি অম্স্নান রাখতে আইবিএর প্রবেশপথে তার মু্যরাল তৈরি করছে। মাস্টার্সের সেরা ছাত্র হিসেবে এবার তার নামে স্বর্ণপদক দেওয়া হবে।’ জানালেন পরিচালক ড. এ কে এম সাইফুল মজিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও গণযোগাযোগ এবং সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, বিজনেস ফ্যাকাল্টির বিশতলা ভবনটি শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’-এর নামে নির্মাণ করা হবে।

খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার বড় ভাই ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল (অব.) মোস্তফা কামালউদ্দিন ভূঁইয়া জানান, ঢাকার মালিবাগ রেলগেট থেকে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের বিশ্ব রোডটি ‘খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া নামে নামকরণ করা হয়েছে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শহীদ মিনারটিও ‘খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া বীর-উত্তম শহীদ মিনার’ নামকরণ হয়েছে।

কথা হয় শহীদ বীর-উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়ার কানাডা প্রবাসী ভাতিজা এহতেশাম ইকবাল ভূঁইয়া জানান, কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার মালাপাড়া গ্রামে ‘খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া বীর-উত্তম নামে কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে গ্রামের বাড়িতে। কবরী-বাগিচাগাঁও এবং মূল কান্দিরপাড় থেকে পুলিশলাইন সড়কের নামও ‘বীর উত্তম খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া সড়ক’ রাখা হয়েছে।

সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার লক্ষ্ণীপ্রসাদ পূর্ব ইউপির মন্তাজগঞ্জ বাজার সংলগ্ন বড়খেয়ড় এলাকায় শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’র কবর কমপ্লেক্স ও স্মৃতিস্তম্বের পার্শ্বে তার নামে একটি মসজিদ ও একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এছাড়া বড়খেয়ড় এলাকায় তার নামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রস্তাব প্রক্রিয়াদিন রয়েছে।

শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’র নামে কানাইঘাটের মন্তাজগঞ্জ-বড়খেয়ড় রাস্তা এবং প্রস্তাবিত (মন্তাজগঞ্জ-দর্পনগর) সুরমা ব্রিজটি তার নামে নামকরণের জোরালো দাবি করছেন এলাকাবাসী। এদিকে শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া বীর-উত্তম’র স্মৃতি রক্ষায় প্রতি বছর ৪ সেপ্টেম্বর তার স্মরণে স্মৃতি কমপ্লেক্স মাঠে শাহাদাৎবার্ষিকী এবং ১৯ ফেব্রম্নয়ারি জন্মদিন পালন করে শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ‘বীর-উত্তম’ স্মৃতি পরিষদ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর দ্বিতীয়। আমার বড় ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া (বীর উত্তম) বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক (মরণোত্তর) পুরষ্কারে ভূষিত হওয়ায় আমাদের পরিবার, গ্রাম, উপজেলা ও সমগ্র কুমিল্লা জেলার জন্য এক বিরাট সম্মান ও গর্বের অর্জন।গত ২৩ মার্চ সকালে ঢাকা ওসমানী মিলনায়তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আমার ভাইয়ের এই সম্মাননা পদক আমাদের পরিবার গ্রহন করেন।

“স্বাধীনতা পুরস্কার” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার। ব্রাহ্মণপাড়ার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কারে ভূষিত হওয়া ব্রাহ্মণপাড়া তথা সমগ্র কুমিল্লা জেলার জন্য এক বিরাট সম্মান ও গৌরব অর্জন। এই বিশাল প্রাপ্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধা বীর উত্তম শহীদ খাজা নিজামউদ্দিন ভূঁইয়া ও তার পরিবারের সকলকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।

শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন (বীরউত্তম) এর সহোদর জনাব হাজান মহিউদ্দিন ভূইয়া মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে স্বাধীনতা পুরুস্কার ২০২৩ গ্রহন করেছেন।